ইমরুল কায়েস,সিনিয়র রিপোর্টার(কুটনৈতিক), বাংলাভিশন: গত বছর ডিসেম্বরে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের সংবাদ সংগ্রহে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গিয়েছিলাম। একদিন রাতে বন্ধুদের সঙ্গে রাস্তায় ঘুরছি। উপভোগ করছি রাতের প্যারিসের সৌন্দর্য। রাত ১১টার মতো হবে। রাস্তাঘাটে জনসমাগম কম। হঠাৎ এক জায়গায় খেয়াল করলাম, রাস্তার পাশে ফুটপাতের কিনার ঘেঁষে দুজন লোক বিছানা পেতে শুয়ে আছেন। দেখে মনে হল, দারিদ্র্য কিংবা ঘরবাড়ি না থাকার কারণে তারা রাস্তায় শুয়ে আছেন বিষয়টি তেমন নয়। যা হোক, আমি সঙ্গে থাকা প্রবাসী বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপারটা কী? এরা এভাবে রাস্তায় শুয়ে আছেন কেন? তারা জবাব দিল, ওরা প্যারিসে ‘প্যানা’ নামে পরিচিত।
অভাব বা কষ্টের কারণে তারা বাইরে শুয়ে আছেন এমন নয়। অতিরিক্তি সৌম্যরস পানে তাদের এ দশা দাঁড়িয়েছে। আবার ১৪ ডিসেম্বর যেদিন ল্যুভর জাদুঘরে গিয়েছিলাম সেদিনও জাদুঘরের সামনের ফুটপাতে এরকম দুজনকে রাস্তায় শুয়ে থাকতে দেখেছি। তবে তারা বিছানা করে নয়, রাস্তার ফুটপাতের ওপর পেপার বিছিয়ে শুয়েছিলেন। তখন সকাল ৬টা বা ৭টা হবে। পাশ দিয়ে শত শত মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে; কিন্তু বেচারারা অঘোর ঘুমে অচেতন। এত শীতের মধ্যেও বালিশ, কাঁথা ছাড়া কীভাবে এরা শুয়ে রয়েছেন, আল্লাহ মালুম। হায়রে প্যারিস, বিচিত্র এখানকার মানুষ, তার চেয়েও বিচিত্র তাদের শখ। মাত্রাতিরিক্ত শরাব পান করতে করতে তাদের এমন অবস্থা হয়েছে। প্যারিসে এরা প্যানা হিসেবে চিহ্নিত। যেখানে-সেখানে জলবিয়োগ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না এরা। মেট্রোস্টেশনে আমিও একবার তাদের একজনের এমন কর্মসম্পাদন করতে দেখেছি। পুলিশও নাকি এদের ঘাঁটায় না।
জলবায়ু সম্মেলনের সংবাদ সংগ্রহের কাজ শেষ করে প্রায় প্রতিদিনই প্যারিসের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার চেষ্টা করি। ৪ ডিসেম্বর বিকালে কাজ শেষে বাংলাভিশনের প্রতিনিধি দ্বীপের সঙ্গে ঘুরতে বের হলাম। কনকর্ড নামক একটি জায়গা। নোয়েল বা বড়দিন উপলক্ষে প্রতি বছরই জায়গাটি সাজানো হয়। স্থির হল আমরা সেখানে যাব। সন্ধ্যার দিকে আমরা ওই জায়গায় গেলাম। রাস্তার দু’পাশের পাশাপাশি পুরো এলাকা আলোকসজ্জিত করা হয়েছে। পাশের ভবনগুলোতেও জ্বলছে লাল-নীল বাতি। এসব দেখতে দেশী-বিদেশী পর্যটকরা জড়ো হয়েছেন। দ্বীপ বলল, সন্ত্রাসী হামলা না হলে নাকি আরও পর্যটকের ভিড় হতো। যা হোক, বড়দিন উপলক্ষে লম্বা লাইনে বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে সাজানো স্টলগুলো আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছি। এরই মধ্যে আমার পেটের নিুভাগে চাপ অনুভব করতে লাগলাম। চাপ ক্রমশই বাড়তে লাগল। এক সময় বুঝতে পারলাম ওই চাপ সামাল দেয়া ক্রমেই আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠছে। কিন্তু আমি তো প্যানা নই, যেখানে-সেখানে চাপমুক্ত হওয়া যাবে না। আবার বেশি সময় চেপেও রাখা যাবে না, পাছে কিডনি বেচারারা আবার মাইন্ড করে কর্মে ক্ষান্ত দেয় কিনা তা নিয়েও টেনশন হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দ্বীপকে জানাতেই বিষয়টির গভীরতা উপলব্ধি করে উপায় বাতলে দিল। পাশেই পাবলিক টয়লেট, সেখানেই যেতে হবে। সেখানে যেতেই দেখলাম সাদা-কালো মেশানো কয়েকজন যুবক আড্ডা দিচ্ছে। আমাকে দেখেই হেতু বুঝতে পেরে তাদের মধ্যকার একজন এগিয়ে এসে বলল, এইটটি সেন্ট। বুঝলাম বিনা পয়সায় জলত্যাগ হবে না। পকেট থেকে পয়সা বের করে দিয়ে দিলাম। এরপর ঢুকলাম ছোট্ট ঘরটিতে। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মনে পড়ল আমাদের ঢাকার পাবলিক টয়লেটের বেহাল দশার কথা। তীব্র আর উৎকট গন্ধের কারণে সুস্থ লোকও অসুস্থ হয়ে পড়ার উপক্রম হয়। অপরিচ্ছন্নতার কারণে বেশিরভাগ পাবলিক টয়লেট থাকে ব্যবহারের অনুপযোগী। কিছু পাবলিক টয়লেটে কার্যসম্পাদন করতে পয়সা লাগলেও তা প্যারিসের মতো এত বেশি নয়। টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য দেখভালের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা দু’-চার টাকা চাইলে অনেকের মাথা গরম হয়ে যায়। অথচ প্যারিসে একবার এ কর্মসম্পাদনের জন্য বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৬০ টাকার মতো গুনতে হল। তবে আশার কথা হচ্ছে, ঢাকার পাবলিক টয়লেটের অবস্থা উন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছেন উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র। সুইডেনের সহায়তায় গত এপ্রিলে তেজগাঁও এলাকায় চারটি অত্যাধুনিক পাবলিক টয়েলেট নির্মাণ শেষে উদ্বোধন করেছেন তিনি। মাত্র পাঁচ ও দশ টাকার বিনিময়ে রাস্তায় চলা নারী-পুরুষ উভয়েরই ব্যবহারের বন্দোবস্ত রয়েছে টয়লেটগুলোতে। সে সময় তিনি ঘোষণা দেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় একশ’ পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হবে। সিএনজি পাম্প স্টেশনগুলোতে সিটি কর্পোরেশন উন্নত পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করতে চায় জানিয়ে জায়গা বরাদ্দ দিতে মালিকদের প্রতি আহ্বানও জানান তিনি। এখন দেখার বিষয় মেয়র মহোদয়ের একশ’ পাবলিক টয়লেট নির্মাণের এ ঘোষণা বাস্তবে কতটুকু রূপ লাভ করে।
মেয়রের এ উদ্যোগ পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে নগরবাসী হয়তো এর সুফল একদিন পাবে। তবে সে সময় পর্যন্ত যেসব পাবলিটক টয়লেট বর্তমানে আছে তা ব্যবহার উপযোগী রাখতে উভয় সিটি কর্পোরেশনকে উদ্যোগ নিতে হবে সর্বাগ্রে।
(দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত)