রাজবাড়ী টুডে ডট কম, ডেস্ক: ২০৫০ সালের আগেই বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। এতে করে জলবায়ু পরিবর্তন বিপদজনক হয়ে উঠবে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে শীর্ষস্থানীয় একদল বিশেষজ্ঞ বলেছেন এ কথা। ‘দ্য ট্রুথ অ্যাবাউট ক্লাইমেট চেঞ্জ’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে উঠে এসেছে এ বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা। তারা বলেছেন, অনেকেই হয়তো বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে ‘বিমূর্ত, দূরবর্তী ও বিতর্কিত’ মনে করে থাকেন। কিন্তু প্রবন্ধের অন্যতম লেখক ও ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের সাবেক প্রধান অধ্যাপক স্যার রবার্ট ওয়াটসন বলছেন, অনুমানের চাইতে ‘অনেক বেশি দ্রুতগতিতে’ বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ছে। তাদের বিশ্লেষণ সঠিক হলে, বর্তমানে জীবিত মানুষের বেশিরভাগই তাদের জীবদ্দশায় বিপদজনকভাবে উচ্চতাপমাত্রার একটি গ্রহে বসবাসের অভিজ্ঞতা লাভ করবেন। এ খবর দিয়েছে লন্ডনের অনলাইন দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট।
খবরে বলা হয়, গত বছরের প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি রাখতে সম্মত হন। ওই সময়ের তাপমাত্রার তুলনায় এখন তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হয়ে পড়লে তা নিরাপদ হবে না, এমন আশঙ্কা ছিল। কিন্তু গত বছরেই উষ্ণতা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশিতে গিয়ে ঠেকে। এর আগের তিন বছরেই এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় ০.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। খরা, বন্যা, বনে আগুন এবং ঝড়Ñ এর সবই বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে। এতে ঝুঁকিতে পড়বে ফসল এবং অনেক প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদনে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে, ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বিশ্বকে স্থির রাখার ঘোষণা এরই মধ্যে প্রায় নিশ্চিতভাবেই পূরণ হওয়ার লক্ষ্য পেরিয়ে গিয়েছে। এমনকি যদি প্যারিসের সম্মেলনে প্রতিশ্রুত সব দেশই কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে দেয়, ২০৩০ সাল নাগাদ তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি বেশিতে গিয়ে ঠেকবে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ পৌঁছে যাবে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশিতে।
রসায়নবিদ অধ্যাপক ওয়াটসন নাসা, বিশ্বব্যাংক ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে কাজ করেছেন। বর্তমানে নরউইচে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক গবেষণায় নিয়োজিত এই অধ্যাপক বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন এখই ঘটছে এবং ধারণার তুলনায় অনেক বেশি গতিতে তা ঘটছে। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে প্যারিস সম্মেলন সঠিক পথে একটি পদক্ষেপ। কিন্তু প্রয়োজন এর চেয়ে দ্বিগুণ বা তিন গুণ বেশি প্রচেষ্টা। কার্বন নিঃসরণ করা প্রধান দেশগুলোর পক্ষ থেকে বাড়তি প্রচেষ্টা গ্রহণ না করা হলে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যও আরও আগেই অর্জিত হয়ে যেতে পারে।’ ‘দ্য ট্রুথ অ্যাবাউট ক্লাইমেট চেঞ্জ’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এরই মধ্যে নিঃসৃত হওয়া গ্রিন হাউজ গ্যাসের কারণে আরও বাড়তি ০.৪ থেকে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়তে পারে। এতে আরও বলা হয়েছে, প্যারিস ঘোষণার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য সম্মেলনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ধনী দেশগুলোকে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার দিতে হবে। অধ্যাপক ওয়াটসন বলেন, ‘প্রতিশ্রুতির প্রায় ৮০ ভাগই উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে দেয়া আর্থিক ও কারিগরি সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। এসব শর্ত না মানা হতে পারে। যার অর্থ হলোÑ এই প্রতিশ্রুতিগুলোও পূরণ না হতে পারে।’ এর মধ্যেই যেমন যুক্তরাজ্য ইঙ্গিত দিয়েছে যে তাদের অংশটি আসবে বিদেশি সহায়তা বাজেট থেকে। যার অর্থ হলো দরিদ্র দেশগুলো এখন যা পাচ্ছে তার চেয়ে বেশি পাবে না।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি হবে না, এমন সুযোগ নেই বললেই চলে। এতে বলা হয়েছে, ‘২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কখন বৃদ্ধি পাবে, এটা উদ্বেগের বিষয় নয়। উদ্বেগের বিষয় হলো এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে কী প্রভাব পড়বে সেটা। ১৯৯০ সাল থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়াগত ঘটনা দ্বিগুণ হয়েছে। আগামী কয়েক দশকে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি বাড়লে এসব ঘটনা আরও দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এসব ঘটনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানির উৎস, খাদ্যের উৎপাদন, মানব স্বাস্থ্য, সেবা, গ্রাম ও নগরের অবকাঠামোসহ আরও অন্যান্য বিষয়ের ওপর এগুলোর প্রভাব আরও বাড়বে এবং তীব্র হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু প্রভাব হয়তো উপকারী হতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগই তা হবে না। তা সব খানের জীবন ও জীবিকাতেই নেতিবাচক প্রভাব রাখবে।’
২ ডিগ্রি সেলসিয়াস গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঠেকানোর সময়কে পিছিয়ে দেয়ার মতো সময় এখনও রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর জন্য জ্বালানি উৎপাদন ও এর ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন আনার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা ইলেকট্রিক গাড়ি ব্যবহারের দিকে যাওয়ার কথা বলেছেন। তারা জীবাশ্ম জ্বালানির পাওয়ার স্টেশন ও শিল্প কারখানা থেকে কার্বন গ্রহণ ও সংরক্ষণের দিকে যাওয়ার কথাও বলেছেন। বন ধ্বংস রোধ করার পাশাপাশি কার্বন শোষণ করে এমন গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব ‘অনিবার্য’ ক্ষতিকর প্রভাব এরই মধ্যে আমাদের সামনে রয়েছে, সেগুলো মোকাবিলা করার জন্য মানুষকে পদক্ষেপ নিতে হবে বলেও জানিয়েছেন গবেষকরা। প্রতিবেদনের আরেক লেখক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিদ্যার অধ্যাপক জেমন ম্যাককাথি বলেন, আঞ্চলিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অভিযোজনমূলক সঠিক পদক্ষেপ নেয়াটা জরুরি।
আরেক গবেষক মার্ক লিনাস এই প্রতিবেদন ‘দ্য ট্রুথ অ্যাবাউট ক্লাইমেট চেঞ্জ’ প্রতিবেদনে উঠে আসা বিষয়গুলোকে ‘চূড়ান্ত উদ্বেগকর’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে গেলে আমরা এই শতকের শেষ নাগাদ ৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির পথে থাকব। এতে হিমবাহ গলতে থাকবে পূর্ণগতিতে। আমাদের শষ্য উৎপাদনের স্থান পরিণত হবে মরুভূমিতে। বিশ্ব পড়বে খাদ্য সংকটের তীব্র হুমকিতে। তিনি বলেন, ‘আমরা সম্ভবত গ্রীষ্মম-লীয় প্রবাল প্রাচীর হারাব। এর সঙ্গে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বড় একটি অংশই বিলুপ্তির পথে থাকবে। আর আমরা আমাদের সন্তান ও নাতি-নাতনীদের নিন্দা করব সমুদ্রের উচ্চতা কয়েক মিটার বেড়ে যাওয়ার কারণে। তাতে বেশিরভাগ উপকূলীয় শহরটি শেষ পর্যন্ত খালি হয়ে যাবে।’