ইমরুল কায়েস : দিন যতই গড়াচ্ছে ততই জমে উঠছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী ডেমোক্র্যাটিক দলের হিলারি ক্লিনটন এবং রিপাবলিকান দলের ডোনাল্ড ট্রাম্প একে অপরের অতীত ইতিহাসের কাসুন্দি ঘেঁটে সামনে নিয়ে আসছেন অনেক অজানা তথ্য যা মার্কিন মুলুকের নির্বাচনী বাজারকে দিনকে দিন গরম করে তুলছে। এতে তারা ভোটারদের কতখানি প্রভাবিত করতে পারছেন তা হয়তো নির্বাচনী ফলাফলই বলে দেবে।
তবে অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগের এমন তীর বর্ষণ আগের সব মার্কিন নির্বাচনের তুলনায় বর্তমান নির্বাচনকে যে বেশী হিংসাত্বক এবং কদর্যময় করে তুলেছে তা নির্দিধায় বলা যায়। ডেমোক্র্যাট হিলারির তুলনায় রিপাবলিকান ট্রাম্পের অতীত ইতিহাস যে বেশী দুর্গন্ধময় তা বিশ্ব মিডিয়ার কল্যাণে জানতে পারছে বিশ্ববাসী। হিলারির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রথম দফায় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো কয়েক হাজার ইমেইল পরে তিনি মুছে ফেলেছেন। ওইসব ইমেইলে কি ছিল, কেন তিনি সেসব মুছে ফেললেন তা নিয়ে নির্বাচনী মাঠ সরগরম করার চেষ্টা করছে ট্রাম্প শিবির। তবে হিলারির বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এই সব অভিযোগ যে ধোপে টিকবে না তা মার্কিন নির্বাচন নিয়ে করা সাম্প্রতিক জরিপগুলোই বলে দিচ্ছে। বিবিসি, সিএনএন, ওআরসিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের জরিপে দেখা যাচ্ছে হিলারি প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্পের চেয়ে কমপক্ষে সাত/আট শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন এক অভিযোগ ফেঁদেছেন হিলারির বিরুদ্ধে। হঠাৎ করেই তিনি অভিযোগ এনেছেন হিলারি ক্লিনটন মাদক সেবী। গত ১১ অক্টোবরে দ্বিতীয় দফা নির্বাচনী বিতর্কের আগে হিলারি নাকি মাদক নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ ট্রাম্পের। এমনকি ড্রাগ টেস্টের জন্য তিনি হিলারি ও তার নিজের রক্ত পরিক্ষারও আহ্বান জানিয়েছেন।
আর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগের ফিরিস্তি রয়েছে তা লেখা শেষ করার নয়। নির্বাচনী প্রচারের প্রথম দিন থেকেই নানা বেফাঁস মন্তব্য করে তিনি রয়েছেন আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে। ক্ষমতায় গেলে তিনি অভিবাসীদের আমেরিকা ছাড়া করবেন বলে হুশিয়ারি দিয়েছেন। এমনকি ধর্ম নিয়েও কটাক্ষ করতে ছাড়েন নি তিনি। উন্মাদের মতো ইসলাম ধর্মকে জঙ্গিবাদের দোসর অভিহিত করে মুসলিমদের আমেরিকা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলেছেন বিতর্কিত এই রাজনীতিক। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত মসজিদগুলোকে নজরদারিতে আনার প্রস্তাব করেই ক্ষান্ত হননি ক্ষমতায় গেলে তা বাস্তবায়ন করবেন বলে হুমকি দিয়েছেন তিনি। এসব কথা বলে মুসলিম ভোটারদের যেমন চটিয়েছেন তেমনি নিজের ভেতরে থাকা কুৎসিত বর্ণবাদী মনোভাবও ফুটিয়ে তুলেছেন ট্রাম্প। তার অতীত কার্যকলাপও তাকে সমালোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। বেশ কয়েকজন নারী এরইমধ্যে তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানীর অভিযোগ এনেছেন। এমনকি নারীদের নিয়ে তার করা বাজে মন্তব্যের একটি ভিডিও সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস ফাঁস করার পর তার আসল রুপ ফুটে উঠেছে।
কর আইনের ফাঁক গলিয়ে ১৯৯৫ সালে নিজের কোম্পানীর ৯১ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার ক্ষতি দেখিয়ে দীর্ঘ প্রায় ২০ বছরের মতো কর এড়িয়ে থেকেছেন তিনি। বিরোধী শিবিরের দাবি সত্ত্বেও কর সংক্রান্ত কোন নথি প্রকাশে অস্বীকৃতি জানানোর পাশাপাশি কর এড়িয়ে থাকার বিষয়টিকে তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বলে জাহির করছেন। একারণে হিলারি ক্লিনটন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পোস্টার বয় অব রিগড সিসটেম (Rigged system) আখ্যায়িত করে বলেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে বিদ্যামান কর ব্যবস্থা আরো খারাপ হবে ।পরিস্থিতি যখন এরকম তখন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন নাকি স্ত্রী হিলারিকে পরামর্শ দিয়েছেন চুপ থাকতে। বলেছেন, তোমার কিছু বলার দরকার নেই, মুখ বুজে দেখ, ট্রাম্প নিজেই নিজেকে পুড়িয়ে মারবে। প্রবাসী সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার এমনই খবর দিয়েছে জাতীয় একটি দৈনিকে (প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণ, ১৭.১০.১৬)।
ট্রাম্পের অতীত ইতিহাসের কদর্য দিকটি যখন একে একে গণমাধ্যমগুলো প্রকাশ করছে ঠিক তখনি গণমাধ্যমকেও একহাত নিতে ছাড়েন নি তিনি। ট্রাম্পের অভিযোগ প্রভাবশালী কিছু গণমাধ্যম এবং ডেমোক্র্যাটরা মিলে ভোট কারচুপির চক্রান্ত করছে। আমেরিকার নির্বাচনী ব্যবস্থা ক্রুটিযুক্ত বলেও অভিযোগ এই ব্যবসায়িক কাম রাজনীতিকের। ১৬ তারিখে দেয়া এক টুইট বার্তায় আরো একধাপ এগিয়ে তিনি অভিযোগ করেছেন অসংখ্য ভোট সেন্টারেও নাকি ভোট কারচুপির ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তবে এর স্বপক্ষে তিনি কোন প্রমাণ এখনো হাজির করতে পারেননি। ১৭ তারিখ উইসকনসিনের গ্রিন বে’তে নির্বাচনী প্রচার সভায় তিনি অভিযোগ করেন আমেরিকার ২ কোটি ২৪ লাখ ভোটারের রেজিস্ট্রেশন বৈধ বা সঠিক (no longer valid or singnificantly accurate) নয়। অবৈধ অভিবাসীদের ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, ১৮লাখ (Diseased) রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে ভোটার করা হয়েছ যারা তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ভোট দেবেন বলে আশংকা তার।
ট্রাম্পের এসব অভিযোগ অবশ্য নিজ দলেই ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। রিপাবলিকান দলীয় শীর্ষ নেতা হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ এর স্পিকার পল রায়ান বলেছেন মার্কিন নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ফলাফলের ওপর জনগণ এবং তার আস্থা আছে। এমনকি খোদ ট্রাম্পের রানিংমেট মাইক পেন্সও এনবিসি নিউজের মিট দ্যা প্রেস অনুষ্ঠানে বলেছেন নির্বাচনী ফলাফল তারা অবশ্যই মেনে নেবেন। এছাড়া ওহাইও’র রিপাবলিকান নেতা জন হাস্টেড, রিপাবলিকান দলীয় নির্বাচনী আইনজীবী ক্রিস অসবি, কেনটাকির সাবেক রিপাবলিকান সেক্রেটারি অব স্টেট ট্রে গ্রেইসনসহ দলীয় নেতারা ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থাতেই আস্থা রাখার পাশাপাশি ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তারা।
এখন প্রশ্ন হলো হঠাৎ নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ক্রুটিযুক্ত এবং ভোট কারচুপির ষড়যন্ত্রের কথা কেন বলছেন ট্রাম্প? বিবিসি, সিএসন, নিউইয়র্ক টাইমসসহ প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো বলছে, সাম্প্রতিক জরিপগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিলারির চেয়ে পিছিয়ে পড়া, নিজেকে রাজনৈতিক এলিটদের বিরোধী হিসেবে প্রমাণ করা, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভুক্তভোগী হিসেবে (Anti-estublishment) সমর্থকদের সিমপ্যাথি আদায় এবং সর্বোপরি পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ট্রাম্প এসব প্রশ্ন তুলছেন। পরাজয়ের ভয়ে ভীতু হয়ে ট্রাম্প গা বাঁচাতে আগাম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আকিস্কার করছেন বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। মার্কিন নির্বাচনী ব্যবস্থায় সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট একটি বড় ফ্যাক্টর। যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল ভোট রয়েছে। প্রতিটি রাজ্যে কংগ্রেসম্যান এবং সিনেটরদের অনুপাতে ইলেক্টোরাল ভোটের সংখ্যা নির্ধারিত। কোন রাজ্যে পপুলার ভোটে যে প্রার্থী জয়ী হবে সেই রাজ্যের সব ইলেক্টোরাল ভোট বিজয়ী প্রার্থীর হয়ে যায়। এই হিসেবে সংবিধান অনুযায়ী যে প্রার্থী ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট পাবেন তিনিই প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হবেন। এজন্য অনেক সময় পপুলার ভোট বেশী পেয়েও অনেকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন নি। ২০০০ সালে পপুলার ভোট বেশী পেয়েও ইলেক্টোরাল ভোটে হেরে প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি সেসময়ের ডেমোক্র্যাট প্রার্থী আল গোর। যাহোক, রাজনৈতিক এলিট এবং সচেতন মহল ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিশ্বাস করুক আর না করুক গোঁড়া রিপালকিনরা তার কথায় আস্থা রাখবে বলে বিশ্লেষণ কিছু কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের। কারণ রিপাবলিকান দলের একটি বড় অংশ কট্টরপন্থী স্বল্প শিক্ষিত শ্বেতাঙ্গরা। এদের মধ্যে আবার স্বল্প শিক্ষিত যুবক শ্রেনীই বেশী। ট্রাম্প হেরে গেলে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে তার এসব অভিযোগ স্বল্প শিক্ষিত এই যুবক শ্রেণীর রিপাবলিকানরা সহজেই বিশ্বাস করবে যা দেশটির সমাজ ব্যবস্থায় বিভাজনকেই উসকে দেবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার(কূটনৈতিক), বাংলাভিশন। kayeshdu@gmail.com