মিরাজ হোসেন গাজী: রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি থানা। মাস তিনেক আগে একটি নারী নির্যাতন মামলার তদন্তের জন্য ঐ থানাকে নির্দেশ দেয় আদালত। বাদী রুপা( ছদ্মনাম) আসামি রুপার স্বামী রুবেল, শ্বশুর ও চাচা শ্বশুর।
রুপার অভিযোগ, আসামিরা তাকে শারীরিক নির্যাতন করেছে।
মামলার পর রুপার স্বামীর বড় ভাই রাসেল (ছদ্মনাম ) ঢাকা থেকে মামলার তদন্তকারী পুলিশ অফিসার এসআই আতিক (ছদ্মনাম) এর সাথে যোগাযোগ করেন। বাবার বয়স ৬৫ বছর। মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক। সম্মান রক্ষায় নানা মাধ্যম দিয়েও যোগাযোগ করেন, বালিয়াকান্দি থানায়। রাসেল চাচ্ছিলেন সঠিক প্রতিবেদনটা যেনো আদালতে পাঠানো হয়।
এরই মধ্যে এসআই আতিক(ছদ্মনাম) প্রস্তাব দিতে থাকেন তার সাথে আলোচনায় বসতে। থানার সাথে যোগাযোগ আছে এমন একজনকে দিয়ে আসামি পক্ষের সাথে যোগাযোগও রক্ষা করে চলেন এসআই।
এমন পরিস্থিতিতে আসামিরা ( বাদীর স্বামী রুবেল বাদে) উচ্চ আদালত থেকে আট সপ্তাহের আগাম জামিন নিয়ে আসেন। সেই কপি থানা ও রাজবাড়ীর সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দেন।
এবার এসআই আতিক(ছদ্মনাম) বলতে থাকেন ‘প্রতিবেদন আমি দিবো, আর আট সপ্তাহ পরতো আমি গ্রেফতার করতে পারবো।’
ভাবনায় পড়ে যান রাসেল (ছদ্মনাম) । বয়স্ক বাবাকে যদি হয়রাণি করা হয়, এই ভেবে। এসআইকে তিনি (রাসেল) এসআইকে বলেন, ভাই আপনিতো ঘটনা সবই যানেন, একটা মিথ্যা অভিযোগে মামলা করা হয়েছ। তারপরও আপনার বিষয়টা দেখবো, আপনি প্রতিবেদন দেন।
এসআই আতিক(ছদ্মনাম) বলেন, ‘মামলা মিথ্যা সবাই যানে, তার পরওতো বোঝেন। আপনি আগে বলেন কি করবেন? পরিমান জানাতে আপনার কোন লোককে আমার কাছে পাঠান। এসব বিষয় ফোনে নয়।’
প্রতিনিয়ত এভাবে চলতে থাকে এসআইয়ের দেনদরবার। এর পর ঈদ উল আযহার পর দিন রাজবাড়ী শহরের বড়পুল এলাকায় পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাত হয় এসআই ও রাসেলের। সেই আলোচনায় মূল বিষয় এমাউন্ট বলেন। রাসেল এসআইকে বলেন, আপনি নিজেই বলছেন মিথ্যা অভিযোগ মামলা হয়েছে। তার পরও কেনো টাকা চাচ্ছেন?
এস আই আতিক(ছদ্মনাম) বলেন, ভাই অভিযোগ মিথ্যা সেটাতো জানি, কিন্তু আমাকে ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে হয়। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত। তার পরও রাসেল বলেন, আপনি প্রতিবেদন দেন, আমি আপনাকে খুশি করবো। এমন সময় এসআই বিদায় নিতে নিতে বলেন, ‘আপনি কতো দিতে পরবেন বলেন, নয়তে ওসি স্যারের সাথে কথা বলেন।’
নিরুপায় রাসেল কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এই বিষয় ও পুরো ঘটনা নিয়ে তিনি (রাসেল) পরিচিত কয়েক জনের সাথে পরামর্শ করেন।
সেই মতে, পরদিন(১৫/১৬ সেপ্টেম্বর) রাসেলসহ চার জন রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির এর সাথে দেখা করেন। ঘটনার বর্ণনা শুরু করতেই থামিয়ে দেন এসপি। বলেন, ‘এটাতো সেই মামলা, যেটা শশুর বাড়ীতে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ দেয়ার কৌশল হিসেবে মামলা করেছেন এক নারী।’
তিনি বলন, ‘আমিতো এই মামালা সম্পর্কে জানি। তদন্ত কর্মকর্তাকেতো বলে দিয়েছি ফাইনাল রিপোর্ট দিতে।’
কিন্তু, বাস্তবতা ভিন্ন। এসপি ফাইনাল রিপোর্ট দিতে বললেও, এসআই টাকা আদায়ের জন্য বারবার চাপ দিয়ে আসছিলো আসামি পক্ষকে। এমনকি গ্রেফতারের ভয়ও দেখাচ্ছিলো। এমনকি বাড়ীর নারীদেরকেও মামলায় জড়ানোর হুমকি দিয়ে আসছিলেন।
এসপির এই কথার পর, পুরো ঘটনা বলা হয় তাকে। (যার অডিও ও ভিডিও রেকর্ড রয়েছে) বর্ণনা শুনে সাথে সাথে ঐ এসআইকে ফোন দেয়ার জন্য বলেন এক পুলিশ সদস্যকে।
এসপিকে ফোন করেন বালিয়াকান্দি থানার সেই এসআই। এসপি জিহাদুল কবির জানতে চান,
‘কবে যোগ দিয়ছো এই থানায়? তোমাকে কোন কোন ঘাটে টাকা দিতে হয়?’
তিনি বলেন, ‘যেই মামলায় তোমাকে আমি ফাইনাল রিপোর্ট দিতে বললাম, তুমি এতো দেরি করলা কেনো? তার ওপর তুমি আসামি পক্ষকে হয়রানি করছো? তোমার এতো সাহস আমি ফাইনাল দেয়ার কথা বলার পরেও উল্টো কাজ করছো।একটা…………… বের করে দিবো। এখন ফাইনাল রিপোর্টের নম্বর আমাকে দিবা। আর কোনদিন যদি এমন কাজ করো সরাসরি সাসপেন্ড করে দিবো।’
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মামলার ফাইনাল রিপোর্টের নম্বর এসপিকে জানান ঐ এসআই।
এসপির ভূমিকা দেখে উপস্থিত সকলের চেহারায় জমে থাকা মেঘ কেটে যায়। অনেক দিনের যন্ত্রণা ও ভাবনা থেকে মুক্তি পান রাসেলদের পরিবার।
এসময় রাসেল বলেন, আপনার মতো পুলিশ কর্মকর্তা আছেন বলেই, মানুষ আশায় বুক বাঁধে। বিপদে আলো দেখতে পায়। কৃতজ্ঞতা এসপি জিয়াদুল কবির।
এসপির সাথে রাসেলদের(ছদ্মনাম) সাক্ষাতের একমাস পরও সেই প্রতিবেদন জমা হয়নি আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায়। ফলে আবারও রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার জিহাদুল কবিরকে অবহিত করা হয় বিষয়টি। এর পর অবশ্য ৩/৪ দিনের মধ্যেই মামলার ফাইনাল রিপোর্ট জমা হয় আদালতে।
এসপির প্রথম দফার নির্দেশ, দ্বিতীয় দফায় ধমক, এবং তৃতীয় দফার পদক্ষেপের পর তারই অধীনস্ত একটি থানার এসআই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেন।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন আসতেই পারে, কে বেশি ক্ষমতাধর?
আর তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, কয়জনের সুযোগ হবে এসপি পর্যন্ত যাওয়ার?
এদিকে, মজার বিষয় হচ্ছে, বাদী রুপা এবং এক নম্বর আসামি তার স্বামী রুবেল(ছদ্মনাম) একসাথেই ঢাকায় বসবাস করছেন মামলার পর থেকেই। মাঝখান থেকে পুরো শশুড় বাড়ীর লোকদের মামলার ঘানি টানাচ্ছিলেন।
পরিবারের অমতে অঘটনের মধ্য দিয়ে বিয়ে হয় রুবেল-রুপার। ধারণা করা হচ্ছে,( অনেক ক্ষেত্রে প্রমাণিতও) মহল বিশেষের প্ররোচনায় পরিবারকে চাপ দিতেই এই মামলা। যাতে তাদের মেনে নেয়া হয়।
সে যাই হোক। পুলিশতো সব সত্যই জানতো। তার পরও একটি পরিবারকে যে হয়রাণি করা হলো এতোগুলো দিন তার দায় কে নিবে? কবে এমন কতিপয় পুলিশ সদস্যের ফাঁদ থেকে মুক্তি পাবে সাধারণ মানুষ?
(বিশেষ অনুরোধে অন্য নামগুলো ছদ্মনাম দেয়া হলো)
লেখক: টিভি রিপোর্টার, বাংলাভিশন,ঢাকা।